শুক্রবার, ২৭ মে, ২০১১

সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনাতে নজরুল

আমার পরমপ্রিয়, আমাদের সকলের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১২ তম জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য। কাজী নজরুলের স্বকন্ঠে আবৃত্তি "রবি-হারা" বাংলার সকল নজরুল অনুরাগী মানুষকে উপহার দিলাম। হে বিদ্রোহী কবি, হে মানবতাবাদী কবি, তোমাকে সশ্রদ্ধায় স্মরণ করি।



রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল

আ ব দু ল হা ই শি ক দা র

গ্যাটের পাশে শিলার এবং টলস্টয়ের পরে যদি ম্যাক্সিম গোর্কিকে ধরা হয়, তাহলে সব বৈপরীত্য মাথায় রেখেও বলা যায় বাংলা সাহিত্যে তেমনই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর কাজী নজরুল ইসলাম। এটাই ঐতিহাসিক সত্য। এ জন্যই নজরুল গবেষণার পথিকৃত্ আবদুল কাদির লিখেছেন : ‘রবীন্দ্রনাথের কোমল কান্ত ললিত কথার সুর নজরুল বেঁধে দিলেন বহ্নিরাগে। রবীন্দ্রনাথ গানের তানে জাগিয়েছিলেন,

এক হাতে ওর কৃপাণ আছে/ আর এক হাতে হার। / ও যে ভেঙ্গেছে তোর দ্বার। (গীতালী)।

আর নজরুল ভাঙা-গড়ার নতুন মন্ত্রের উদগাতা হয়ে তাঁর বিখ্যাত বিদ্রোহী কবিতায় বলেন,

আমি ইন্দ্রাণী-সূত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য

মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য।
রবীন্দ্রনাথ নভোলোকবিহারী অমৃতকণ্ঠ অক্লান্ত পক্ষ স্বর্ণবিহঙ্গ, আর নজরুল মর্ত্যের দুঃখ-বাণ-বিদ্ধ বিদীর্ণ-কণ্ঠ আহতপক্ষ ধূলিম্লান পাখি। ঊর্ধ্ব আকাশের দিকে সুরের অঞ্জলি তুলে রবীন্দ্রনাথ নিবেদন করেছেন,
অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন করে?
আকাশ কাঁপে তারার আলোর গানের ঘোরে।
বিষম তোমার বহ্নিঘাতে
বারে বারে আমার রাতে
জ্বালিয়ে দিল নতুন তারা ব্যথার ভরে \ (গীতালী)।
এই বিশ্ববাদকের অগ্নিবীণা বাজছে দিব্যধামে, তাতে মর্ত্যের মানুষের মনে জাগছে নতুন নতুন ভাবের স্ফুলিঙ্গ। কিন্তু নজরুল যে অগ্নিবীণা বাজালেন, তার দীপক রাগে পরাধীন দেশের অধঃপতিত সমাজে জাগলো নবসৃষ্টির উল্লাস-নূতন রাষ্ট্রনীতির চেতনা ও আর্থনীতিক অধিকারবোধ।’
আবদুল কাদিরের এই বক্তব্যের নির্গলিতার্থ অনুধাবন করার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের যে কোনো বিলম্ব হয়নি, তারই স্মারক তাঁর ‘ঐক্যতান’। কবি হিসেবে নিজের অসম্পূর্ণতার পরিপূরক হিসেবেই নজরুলকে চিনেছিলেন, কাছে টেনে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ :
‘সমাজের উচ্চ মঞ্চে বসেছি সংকীর্ণ বাতায়নে।
মাঝে মাঝে গেছি আমি ওপাড়ার প্রাঙ্গণের ধারে;
ভিতরে প্রবেশ করি সে শক্তি ছিল না একেবারে।
জীবনে জীবন যোগ করা
না হলে, কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা।
তাই আমি মেনে নেই সে নিন্দার কথা
আমার সুরের অপূর্ণতা।
আমার কবিতা, জানি আমি
গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সর্বত্রগামী।

কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন,
কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন,
যে আছে মাটির কাছাকাছি
সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি।
সাহিত্যের আনন্দের ভোজে
নিজে যা পারি না দিতে, নিত্য আমি থাকি তারি খোঁজে।’
বলার অপেক্ষা রাখে না রবীন্দ্র প্রত্যাশিত, জাতিকে জাগিয়ে দেয়ার জন্য, সামগ্রিকভাবে সচেতন করবার জন্য, স্বয়ং সম্পূর্ণ করবার জন্য যে সর্বপ্লাবী প্রতিভার তখন দরকার হয়ে পড়েছিল—কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সেই প্রার্থিত প্রতিশ্রুত প্রতিভা। অন্যভাবে বলা যায়, বাংলা কবিতা মাত্র একবার সমুদ্রের ভয়াল গর্জন নিয়ে ফুঁসে উঠেছিল, মাত্র একবার বাংলা কবিতার চির উন্নত শির দেখে সম্ভ্রমে মাথা নুইয়ে দিয়েছিল মহামহিম হিমালয়— মাত্র একবার তেজতপ্ত লাভা শব্দপুঞ্জের সঙ্গে প্রেম ও প্রকৃতির অনন্যসাধারণ মিশ্রণে ভেসে গিয়েছিল বিশ্ব চরাচর, আর তা নজরুল ইসলামের মধ্য দিয়ে।
রবীন্দ্রনাথের মতো মহত্তম কবি প্রতিভার বিশাল ক্যানভাসে বিষয়টি অত্যন্ত পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্নভাবে ফুটে উঠেছিল। এ জন্যই ভারতের রবীন্দ্র অধ্যাপক জ্যোতির্ময় ঘোষ বলেন, “অনুজ তরুণ কবি-লেখকদের মধ্যে যাঁদের মেধা ও মনন রবীন্দ্রনাথের কাছেও সম্ভ্রম উদ্রেককারী মনে হয়েছিল, তাদের তিনি সাদর স্বীকৃতি জানালেও, সম্ভবত নিজের উত্তরাধিকারীরূপে একমাত্র নজরুলকেই স্বতঃস্ফূর্ত-স্নেহ-মমতা-দরদ ও ভালোবাসা ভরে বরণ করে নিয়েছিলেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন