জীবনের জলছবি

মার জন্ম ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১-এ হুগলী জেলার চন্দননগরে। ছেলেবেলা থেকে আজ অবধি চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা। বাবা জ্যোতির্ময় দত্ত স্থানীয় কানাইলাল বিদ্যামন্দিরে শিক্ষকতা করতেন। ক্রীড়াজগৎ থেকে শিল্পকলার জগৎ, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি থেকে চারুকলার দুনিয়া--সবেতেই বাবা ছিলেন প্রবল উৎসাহী ও অনায়াস দক্ষতায় পারঙ্গম। আমার মা সুব্রতা দত্ত গৃহকর্মে ব্যস্ত থাকলেও কখনোই অন্তঃপুরে অন্তরীন ছিলেন না। সাহিত্য ও শিল্পসংস্কৃতিচর্চায় তিনিও ছিলেন গভীর আগ্রহী। মা-বাবা দু'জনেই ছিলেন ওপার বাংলার মানুষ। দেশভাগের যন্ত্রণার সাক্ষী। বাবারা ছিলেন ঢাকায় আর মায়েদের বাসা ছিল রাজশাহী।

দাদু-দিদিমা-মামা-মাসীরা মিলে আমরা চন্দনগরের হাটখোলা রথের সড়কে একই বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। 
বাবা-মা-দিদি ছাড়াও ছেলেবেলায় দাদু-দিদিমা-মামাবাড়ির সান্নিধ্য ও উৎসাহ শিল্পকলা-সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার দিকে আমাকে আরও বেশি করে আকৃষ্ট করেছিল। মাতামহ শচীন্দ্রকুমার চৌধুরী ছিলেন পেশায় শিক্ষক ও সৎ সুপন্ডিত মানুষ। মাতামহী রেণুকা চৌধুরী (আমার আরেক মা) আটপৌরে গৃহবধূ জীবনে অভ্যস্ত হলেও অত্যন্ত বিদুষী, প্রতিভাময়ী ও বহুগুণসম্পন্না ছিলেন। তিনিও বিয়ের আগে প্রথম জীবনে শিক্ষকতা করতেন। এছাড়া গান, নাচ, সাহিত্যচর্চা, খেলাধুলো, অভিনয়, সূচীকর্ম, রন্ধন--সবেতেই দিদিমা ছিলেন সমান পারদর্শিনী।

আমার বই পড়ার নেশা ছেলেবেলা থেকেই। আজীবন মায়ের গায়ের গন্ধের মতোই ভীষণ প্রিয় গন্ধ-smell of printing ink। বর্ণপরিচয়ের আগে থেকেই বইয়ের দুনিয়ায় সানন্দ বিচরণ। কোলে চড়ার বয়সেই দেশবিদেশের রকমারি বইয়ের সাদাকালো ও রংবেরং-এর ছবিদেখা শুরু। প্রথম যে বইটির প্রেমে পড়ি সেটি ছিল জয় আডামসনের সেই বিশ্ববিখ্যাত বই "বর্ন ফ্রী"--আফ্রিকার সিংহী 'এলসা'র সাথে জয় ও জর্জের অসাধারণ জীবন কথা, মানুষ ও না-মানুষের ভালোবাসার গল্প।
 
আজও ভালো ফোটো, স্কেচ ও ইলাস্ট্রেশনের আমি পরম ভক্ত। বইয়ের ছবি দেখে মকশো করার শখও শৈশব থেকেই। ছবিদেখার পাশাপাশি মা-বাবা-দিদি ও মামাবাড়ির সকলেই মুখে মুখে গল্প শোনাতেন।
 বাংলা ছড়া-কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও দেশবিদেশের সাহিত্যের বঙ্গানুবাদের সাথে বাল্যকাল থেকেই অন্তরঙ্গ পরিচয় ও নিবিড় ভালোবাসা গড়ে ওঠে। সোভিয়েত রাশিয়ার আশ্চর্য সুন্দর বইগুলো শৈশবের দিনগুলোকে রঙিন কল্পনায় ভরিয়ে দিত।ছাত্রাবস্থায় এগারো-বারো বছর বয়স থেকে গল্প-ছড়া-কবিতা লেখার মধ্যে দিয়ে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ। বিদ্যালয় জীবনে মাধ্যমিক স্তরের শেষের দিকে প্রবন্ধ রচনা শুরু। ১৯৮৫ সালে নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় সারা বাংলা আন্তর্বিদ্যালয় সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় ছোটোগল্প বিভাগে তৃতীয় পুরস্কার লাভ। পরের বছর ১৯৮৬ সালে রামকৃষ্ণের জন্মের সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে বেলুড় মঠের রামকৃষ্ণ মিশন সারদাপীঠ আয়োজিত সারা বাংলা “আন্তর্বিদ্যালয় প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা”য় প্রথম পুরস্কার লাভ।

ঐতিহ্যমণ্ডিত কানাইলাল বিদ্যামন্দিরে (পূর্বতন ডুপ্লে স্কুল) আমার পড়াশুনো। জীবনের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ শিক্ষয়িত্রী প্রয়াতা সাধনা চক্রবর্তীর গভীর স্নেহ, ভালোবাসা ও প্রেরণায় ধন্য হয়েছে বিদ্যার্থী জীবন। তাঁর অনুপ্রেরণা ও উৎসাহেই ছয়-সাত বছর বয়সে “খুদে বাউল” সেজে হাতে একতারা নিয়ে ইশকুলের মঞ্চে প্রথম গান গাওয়া। অভিনয়, আবৃত্তি, গান, ছবি আঁকার (কার্টুন,স্কেচ ও জলরং) সাথে আশৈশব সখ্যতা। এছাড়া ধাঁধা-হেঁয়ালি, ম্যাজিক, ক্যুইজ, অরিগামি আর খেলার ছলে বিজ্ঞানের এক্সপেরিমেণ্ট ও মডেল বানানো ছিল অবসরের প্রিয় বিনোদন। প্রিয় খেলা ছিল জিম্‌ন্যাস্টিকস্‌, ফুটবল ও ক্রিকেট।

১৯৮৯ সালে আঠারো বছর বয়সে স্কুলের বন্ধুদের সাথে মিলে স্থানীয় গ্রুপ থিয়েটারে নাট্যাভিনয় ও পরিচালনা। চন্দননগরের বাগবাজারের শ্রীতপা চক্রবর্তীর প্রেরণায় ও উদ্যোগে গড়ে ওঠা “কোরক সাংস্কৃতিক সংস্থা”র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলাম। আমাদের অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো ছিল-- বাদল সরকারের “বল্লভপুরের রূপকথা”, শম্ভু মিত্র ও অমিত মৈত্র রচিত “কাঞ্চনরঙ্গ”, মনোজ মিত্রের “চোখে আঙুল দাদা” ইত্যাদি।

ওই বছরেই বাল্যবন্ধু জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের প্রেরণায় বস্তুবাদী দর্শনে দীক্ষা। ভাববাদী চিন্তাচেতনা থেকে মুক্ত হয়ে যুক্তিবাদী নাস্তিক ও বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠা। চন্দননগরের “বিবর্তন বিজ্ঞান সংস্থা”য় সক্রিয়ভাবে গণবিজ্ঞান আন্দোলনে যোগদান। পরে ১৯৯১ সালে “ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি”র কুসংস্কারমুক্তি ও বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদী মূল্যবোধ বিকাশের আন্দোলনে যোগ দিই। বর্তমানে চন্দননগরস্থিত বিজ্ঞান ও মানবাধিকার সংস্থা ভারতের মানবতাবাদী সমিতির সম্পাদক

১৯৮৯ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বিজ্ঞান শাখায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়ার পর “হুগলী ইন্‌স্টিটিউট অফ টেকনোলজি”তে মেক্যানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পাঠ শুরু। মেক্যানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিপ্লোমা পাশ করার (১৯৯২) পর হিন্দুস্তান মোটরস্‌-এর অটোমোবাইল ডিভিসন এবং মার্কেটিং বিভাগে নয় বছরের (১৯৯৩-২০০২ সাল) কর্মজীবন। শেষের দিকে মায়ের শারীরিক অসুস্থতার কারণে মার্কেটিং-এ টেরিটোরি ম্যানেজারের বদলির চাকরি ছেড়েছুড়ে কম্পিউটারে ডেস্ক-টপ পাবলিশিং ও গ্রাফিক্স ডিজাইনের কাজ শিখে স্থানীয় একটি কম্পিউটার শিক্ষণকেন্দ্রের প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দিই (২০০৪-২০০৫ সাল)। পরে মধ্যমগ্রামের “পৌর ও গ্রামীণ সংবাদ” এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত “আজকের পঞ্চায়েত বার্তা”-র সাব-এডিটর হিসেবে কয়েক বছর গ্রামীণ সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা লাভ (২০০৬-২০০৮ সাল)। বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার একটি এনজিও-তে কর্মরত।

প্রথাগত পড়াশুনোর বিষয় প্রযুক্তিবিদ্যা হলেও সাহিত্য, দর্শন, মনোবিজ্ঞান, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব ও লোকসংস্কৃতি নিয়ে পঠন-পাঠনে আগ্রহ ছিল কৈশোর থেকেই। মনেপ্রাণে দ্বান্দিক বস্তুবাদ ও মার্ক্সীয় রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী। পেশাগত জীবনের বাইরে জনপ্রিয় বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ ও অন্যান্য বিষয়ে দৈনিক স্টেটসম্যান, আজকাল, সংবাদ প্রতিদিন, কালান্তর, ওভারল্যাল্ড ইত্যাদি বাণিজ্যিক সংবাদপত্রে ও “উৎস মানুষ”,“টপ কোয়ার্ক”,“একুশ শতকের যুক্তিবাদী”,“কিশোর যুক্তিবাদী” ইত্যাদি বিভিন্ন গণবিজ্ঞান পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করি।

ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির মুখপত্র “একুশ শতকের যুক্তিবাদী” এবং বাংলা ভাষায় ছোটোদের জন্য একমাত্র যুক্তিবাদী পত্রিকা “কিশোর যুক্তিবাদী”র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলাম।
 
আমার
 লেখা উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত বইগুলো হল-- “মনোবিজ্ঞানের আলোকে ঈশ্বরদর্শন” (Mystical vision in the light of Psychology), “অলৌকিক চিকিৎসায় কি রোগ সারে?”(Does Miracle Cure heal diseases?) ও "মানবতার গান" (The Songs of Humanity)

আমার সম্পাদিত গ্রন্থ--“রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-মুক্ত মনের আলোয়”(Ramakrishna-Vivekananda: in the light of freethinking),“অলৌকিক রহস্য সন্ধানে” (In Search of Supernatural Mysteries),“সন্ত্রাসের উৎস আমেরিকা” (America: The origin of terror), "যুদ্ধ ইসলাম প্রতিরোধ" (War Islam Resistance)। শেষ দুটি বইয়ের সহযোগী সম্পাদক ছিলেন বন্ধুবর চিররঞ্জন পাল।

সবকটি বইয়েরই প্রকাশক-- কলেজ স্ট্রীটের Radical Impression

এক ঝলকে আমাদের প্রকাশিত বইগুলো সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক্‌ করুন।

১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ এবং মৌলবাদী আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেকানন্দের জীবন ও বাণীর উপর মৌলিক গবেষণামূলক লেখার জন্য ১৯৯৩ সালে বর্ষসেরা লেখক হিসাবে "ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি"র পক্ষ থেকে “Rationalists’ Award লাভ।
১৯৯৪-৯৫ সাল থেকে আন্দোলনের তাগিদেই গান লেখা, গানে সুর দেওয়াপ্রতিবাদী গণসংগীতের পাশাপাশি জীবনবোধের গান মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষের জীবনের সুখদুঃখের গান দুঃখে-সুখে, আনন্দে-বেদনায়, কান্না-হাসি-অভিমানে, আশা-নিরাশায়, ক্রোধে-ঘৃণায় গানই একমাত্র আশ্রয়

সমকালীন বাংলা গানের নতুন দিশারী কবীর সুমন, গণসংগীতের প্রথিতযশা শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়, বিপুল চক্রবর্তী, প্রবীর বল প্রমুখের সান্নিধ্যলাভে ও তাঁদের গান ভালোবেসেই উৎসাহী হয়েই গান বাধাঁ শুরু। গানের কোনও প্রথাগত তালিম কখনও নেওয়া হয়ে ওঠেনিশৈশবে দিদি সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গানের হাতেখড়ি ও হারমোনিয়ামে সরগম শিক্ষা পরবর্তীকালে বিদ্যালয় জীবনের প্রিয় শিক্ষয়িত্রী, আমার বড়দি (প্রয়াতা সাধনা চক্রবর্তী)-র কাছে এবং কোরক সাংস্কৃতিক সংস্থার প্রাণদাত্রী শ্রীতপাদির কাছে বেশকিছু দেশাত্মবোধক গান ও গণসংগীত শেখা১৯৯৭ সালে প্রবাদপ্রতিম গণসংগীতশিল্পী প্রয়াত সুরেশ বিশ্বাসের সান্নিধ্যলাভে গণসংগীত সম্পর্কে ভাবনার নতুন দিশার খোঁজ পাওয়া।
উৎস মানুষ”, “অনীক, "টপ কোয়ার্ক”, “আকিঞ্চন”, "অহল্যা" ইত্যাদি বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিনে গানের কথা ও স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছে। সব গানের স্বরলিপি করেছেন অগ্রজা সুতপা।

২০০৫ সালে প্রথম গানের সংকলন গ্রন্থ---মানবতার গান প্রকাশিত হয়২০০৭ সালে কলকাতা বইমেলায় আমার কথায়-সুরে দিদির প্রথম গানের অডিও সিডি ও ক্যাসেট পাল্টা স্রোতের গান বের হয়অডিও সিডিটি ছিল যন্ত্রানুষঙ্গ বর্জিত একটি ব্যতিক্রমী প্রয়াস।
এখন বই পড়া ও লেখালেখির ফাঁকে অবসর কাটে গান শুনে, গান বেঁধে, হারানো দিনের গানের ইতিহাস নিয়ে তত্ত্বতালাশ করে আর কম্পিউটারে গ্রাফিক্স ডিজাইনের খামখেয়ালি কাজে।