সোমবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১১

লোকদার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর- বাংলার যুক্তিবাদী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ

"আমার ভাগ্যবিপর্যয় ঘটেছিল পিতার মৃত্যুর পর হতেই। কিন্তু উহা চরমে পুঁছেছিল ১৩১৭ সাল, বিত্তনিলামের পর।........।
আত্মীয় কুটুম্বরা কেহ কোনরূপ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি। দেখেছি অভাবগ্রস্থ ব্যক্তির নিকট হতে- 'আত্মীয় কুটুম্ব সব দূরে সরে যায় কেননা নিকটে পেলে যদি কিছু চায়?' কিন্তু আমাদের তুচ্ছ করে সরে যায়নি মাত্র দু'জন, তারা হল- "উপবাস" ও "ছিন্নবাস"................।"

"আমার মনে বড় রকমের একটা আফসোস ছিল এই যে, তখনো আমি বাংলাভাষা স্বচ্ছন্দে পড়তে পারতাম না, অনেক শব্দই বর্ণবিন্যাস করে পড়তে হত। এতে যে কোন একটি বাক্য অবিরাম না পড়ে ভেংগে ভেংগে পড়বার ফলে ওর অর্থ দুর্বোধ্য হত। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করতে লাগলাম বাংলা ভাষা স্বচ্ছন্দে পড়বার জন্য।
বই কেনার সম্বল নেই বলে এপাড়া ওপাড়ার ছেলেদের পরিত্যক্ত ছেঁড়া বই সংগ্রহ করে পড়তে লাগলাম, পড়তে লাগলাম - পথে পড়ে থাকা টুকরো কাগজ কুড়িয়ে, এমনকি লবন বাঁধা ঠোঙার কাগজও। কোনরূপ লেখা থাকলেই তা হত আমার পাঠ্য। ওতে কি লেখা, কোন বিষয় লেখা, উহা পাঠে কোন জ্ঞানলাভ হল কি-না ইত্যাদি প্রশ্ন ছিল আমার অনাবশ্যক। তখনকার আমার পড়ার উদ্দেশ্য ছিল শুধু- স্বচ্ছন্দে পড়বার ক্ষমতা অর্জন করা।..............।"

এভাবে শুরু। তাঁর ছিয়াশি বছরের জীবনে তিনি সত্তর বছর জ্ঞানসাধনা করেছেন। দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, অংক ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে প্রচুর লেখাপড়া করেছেন। ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞান বিষয়ে বাংলা ভাষায় লিখিত এবং প্রাপ্ত অধিকাংশ গ্রন্থাদি অধ্যয়ন তাঁর জীবদ্দশায় প্রায় বাদ পড়েনি। এসব বিষয়ে বিপুল জ্ঞানের অধিকারী হয়েছেন এক সময়। পান্ডিত্য অর্জন বলতে যা বোঝায় তা হয়েছিল তাঁর।

তিনি দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর।

১৩০৭ বংগাব্দের ৭ পৌষ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বর্তমান বিভাগীয় শহর বরিশালের এক প্রত্যন্ত এলাকায় তাঁর জন্ম। জন্মগ্রহনের পর হতে নিরন্তর সংঘাত প্রতিকূলতার ভেতর দিয়ে আপন জীবনাভিজ্ঞতায় পরিচ্ছন্ন বোধ অর্জন করেছিলেন। কৃষি কাজ ও আমিন পেশায় রত থেকেও এই অগ্রগামী মহাপুরুষ অবিচল আস্থায় সংস্কার ও অন্ধ আবেগের পশ্চাদমুখিনতাকে ক্রমাগত শনাক্ত করেছেন। সংস্কারবিমুখ মুক্তবুদ্ধি চর্চার জন্য পাঠাগার স্থাপন, মানবকল্যাণে চক্ষু ও শরীর দান এবং দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান, গণিত, কবিতা ও আত্মজীবনীসহ বিভিন্ন রচনা- ইত্যবিধ অবদানে মানবমন্ডলকে ঋণী করে গেছেন তিনি।

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, "......আরজ আলী মাতুব্বর প্রথম ও নির্মম যে অন্ধকার সুচিরকাল ধরে স্থায়ী হয়ে আছে এই বাংলাদেশে, তার কথাই বলেছেন তাঁর বইতে। বর্ণনা করে নয়, প্রশ্ন করে।"
হাসনাত আবদুল হাই যথার্থই বলেছেন,"....আরজ আলী মাতুব্বর শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবীদের অহংকার ও আত্মতৃপ্তিকে শক্ত হাতে নাড়িয়ে দিয়েছেন।"

১ চৈত্র ১৩৯২ বঙ্গাব্দে এই মনীষীর জীবনাবসান হয়।

তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।

(গ্রন্থসূত্র: আরজ আলী মাতুব্বর রচনা সমগ্র ১, ২, ৩)

এইখানে ক্লিক্‌ করে আরো কথা পড়ুন।

আরজ আলী মাতুব্বর(১৯০১ - ১৯৮৬) (১৩০৭-১৩৯২ বাংলা) স্ব-শিক্ষিত দার্শনিক, চিন্তাবিদ এবং লেখক। জগত ও জীবন সম্পর্কে নানামুখী জিজ্ঞাসা তাঁর লেখায় উঠে এসেছে যা থেকে তাঁর প্রজ্ঞা, মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়।

সংক্ষিপ্ত জীবনী

বরিশাল শহর থেকে ৭/৮ কিলোমিটার দূরে লামচরি নামক গ্রামে বাংলা ১৩০৭ সনের ৩রা পৌষ এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে আরজ আলী মাতুব্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম এন্তাজ আলী মাতুব্বর। আরজ আলী মাত্র চার বছর বয়সে তাঁর বাবাকে হারান। এর পরে তাঁদের পরিবারটি দেনার দায়ে বসতবাটি ও জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। আরজ আলী নিজ গ্রামের মুন্সি আবদুল করিমের মক্তবে সীতানাথ বসাকের কাছে "আদর্শলিপি" পড়তেন।
দারিদ্রের কারণে তাঁকে মক্তব ছাড়তে হয়। এরপর তিনি কৃষিকাজে নিয়োজিত হন। সাথে সাথে তিনি নিজের ঐকান্তিক চেষ্টায় লেখাপড়া শিখতে থাকেন। কৃষিকাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি জমি জরিপ বা আমিনের কাজ শিখে নেন। এরপর জমি জরিপের কাজকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। এক সময় মানুষ ও জীবন সম্পর্কে তাঁর মনে প্রশ্ন জাগলে তিনি এই বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নিজস্ব ধরণের চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন। তাঁর বেশ কিছু বই প্রকাশিত হলে সুধী সমাজের কাছ থেকে স্বীকৃতি পান। নিজের উপার্জিত অর্থ দিয়ে ১৩৮৬ বঙ্গাব্দে নিজের বাড়িতে 'আরজ মঞ্জিল' পাবলিক লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করেন। স্থানীয় চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান করেন।
মানবকল্যাণে ব্যবহারের জন্য বরিশাল মেডিকেল কলেজকে মরণোত্তর দেহদান করেন। ১৩৯২ বাংলা (ইংরাজি ১৯৮৬ সাল) সনের ১লা চৈত্র তারিখে ৮৬ বছর বয়সে বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।

প্রকাশিত গ্রন্থ

  • ম্যাকগ্লেসান চুলা (১৯৫০)
  • সত্যের সন্ধান (১৯৭৩)
  • সৃষ্টি-রহস্য (১৯৭৮)
  • স্মরণিকা (১৯৮২)
  • অনুমান (১৯৮৩)
  • মুক্তমন (১৯৮৮)

সম্মাননা

  • বাংলা একাডেমী কর্তৃক আজীবন সদস্য পদ প্রদান এবং বাংলা ১৩৯২ সালের ১লা বৈশাখ নববর্ষ সংবর্ধনা জ্ঞাপন।
  • হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার (১৩৮৫ ব.)
  • উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী কর্তৃক বরণীয় মনীষী হিসেবে সম্মাননা (১৩৯২ ব.)
এই লেখাটি "উইকিপিডিয়া" মুক্ত বিশ্বকোষের সৌজন্যে প্রাপ্ত


সৌজন্য- অভিজিৎ রায়

ফেসবুকে আরজ আলী মাতুব্বর-এর কমিউনিটি- এখানে ক্লিক্‌ করুন।



উইকিপিডিয়ায় আরজ আলী মাতুব্বর-এর জীবনী পড়তে এখানে ক্লিক্‌ করুন


Aroj Ali Matubbar was a truly homegrown philosopher without any formal academic training -he had not, in fact, attended any institution of higher learning. Yet, after his death in 1985, Aroj Ali Matubbar came to be regarded as one of the most brilliant rationalists the country has over produced, and as an iconoclast who was not afraid to speak out against entrenched beliefs and superstitions which easily lead to religious fanaticism. A practicing Muslim himself and a pious man throughout his life, Matubbar took it as a mission to strike at the roots of all superstitions and fanatic half-beliefs, and thereby restore the balance between science and religion. It was a difficult task no doubt, especially in a country with low literacy where there is practically no tradition of informed debates on dogmas, creeds, beliefs and religion. Matubbar's books are probably the first such attempts to introduce enlightened discussion and debate about a number of ideas and issues that have exercised the minds of religious philosophers and ordinary followers of Islam over the ages.

Matubbar was born in the Bengali year 1307 (corresponding to 1900 A.D.) in a poor farming family in the village Lamchori in Charbaria union, about 11 k.m. from Barisal town. His father did not have any land, and after his death, Matubbar had to look after his mother and his younger sister. He had practically no schooling, because he had to work to fend for the family's upkeep. He embarked on a program of self- teaching, borrowing books from the libraries and from individuals interested in education. Through hard work, Matubbar was able to improve the family's material condition; he acquired some land, began farming himself, and, with the spare money, bought books. By the time the 1961 cyclone hit his house and blew it away into the river Kirtankhola, his personal library had several thousand books. All the books were lost.
Aroj Ali Matubbar befriended a number of scholars and academics of Barisal town --noted among whom were Professor Kazi Golam Kadir and Professor Muhammad Shamsul Haque, and through then, a number of others. Their encouragement and patronage helped him publish his books-- which were always in danger of being banned by an over- sensitive government. Matubbar was arrested and taken into police custody for his The Quest for Truth. Throughout his life, he was subjected to harassment and threat for his writings-much of which rattled religious institutions and religious fanatics. But to a large number of his readers, his writings were -to use a cliche -a breath of fresh air in the stifling atmosphere of bigotry, zealotry and religious intolerance. 
Matubbar's other main work besides The Quest for Truth, is The Mystery of Creation. Professor Muhammad Shamsul Haque suggests that these two books are like a pair of eyes. Matubbar, incidentally, had donated his eyes for transplantation after his death. He had also written a series of other essays dealing with religion, philosophy and ethics. He also left behind some manuscripts of some unfinished work, including one on his philosophy of life. Aroj Ali Matubbar died on the 1st Chaitra of the Bengali year 1392 (1985 A.D.).
Credit : Pathak Shamabesh, Dhaka.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন