শুক্রবার, ২২ এপ্রিল, ২০১১

বাউল-ফকিরদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ হোক


বাউল-ফকিরদের ওপর নিপীড়ন : গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতি চ্যালেঞ্জ


এই প্রতিবেদনটি "সাপ্তাহিক বুধবার"-এর সৌজন্যে জনসচেতনতা গঠনের উদ্দেশ্যে পুনর্মুদ্রিত। 
অরূপ রাহী ● ‘একা মেরে সাঁই, ফেরে সর্বঠাঁই/মানুষে মিশিয়া হয় বিধান তার/মানুষগুরু নিষ্ঠা যার/সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার’ -লালন ফকির

‘মানুষ থুইয়া খোদা ভজ এ মন্ত্রণা কে দিয়াছে/মানুষ ভজ কোরান খোঁজ পাতায় পাতায় লেখা আছে’ -জালালউদ্দিন ফকির

রাজবাড়ী রূপক হয়ে ধরা দিল বাংলায়। রাজার বাড়িতে ফকিরের ওপরে নিপীড়ন চলছে। সারা বাংলাদেশ রাজবাড়ী। প্রতিদিন বাউল-ফকিরদের ওপর নিপীড়ন চলে। সব ঘটনার খবর হয় না। রাজবাড়ির পাংশার হাবাসপুরের  ঘটনা একটা মাত্রা ছাড়িয়েছে বলে তা খবর হয়েছে। বাউল-ফকির-সহজিয়া-কর্তভজা-সাহেবধনী-বলাহারি-পঞ্চসখী-সুফি-বৈষ্ণবরা তো রাজা নয়। রাষ্ট্রও বানায়নি তারা। ফলে রাজার বাড়িতে তারা ফকির-মিসকিন। কখনো ভিক্ষা পাবে। কখনো বিতাড়িত হবে। সেই কতকাল আগে থেকে চলে আসা ঘটনার পুনরাবৃত্তি! নতুন কি? প্রাথমিক উত্তেজনা শেষ হয়েছে। এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে তদন্ত ও বিচার দাবি করেছেন সংবেদনশীল বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন। থানায় মামলা করেছেন ফকিররা। অনেকেই এই নিপীড়নের প্রতিবাদ-প্রতিরোধে এগিয়ে এসেছেন তাদের প্রতি সংহতি জানিয়ে।

২.

অনেকে হায় হায় করে উঠেছেন। ফতোয়া দিয়েছেন, স্থানীয় মাদ্রাসার মুফতি আর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা সেই ফতোয়া বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ আমলে এ ঘটনা কেমন করে সম্ভব? এর কারণ : আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষ দল বলে দাবিদার। কথাটা কি ঠিক? তাদের সাইনবোর্ড, ইশতেহারে যদিও সে কথা বলা আছে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ তো তখনি সম্ভব যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা সমাজ ধর্মের পর্যালোচনা করেছে। ধর্মের সামাজিক-ঐতিহাসিক পর্যালোচনা না করে একটা দল কি করে নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ দাবি করে? আওয়ামী লীগের এ যাবৎকালের দলিলপত্র কি প্রমাণ দেয়? আজকের দিনের আওয়ামী লীগের ঘোষণা কি প্রমাণ দেয়? তারা তো বলে যে, তারা কোরান-সুন্নাহবিরোধী আইন করবে না। এটা কি কোনো সাবভার্সিভ রাজনৈতিক কৌশল? আওয়ামী লীগের শ্রেণী, অবস্থান ও রাজনৈতিক লক্ষ্য যা, তাতে সে রকম ভাবার সুযোগ নেই। ফলে এটা তাদের রাজনীতির দেউলিয়াত্ব।  আজকের আওয়ামী লীগ যদি বলে, তারাই দেশে ইসলামি আইন বাস্তবায়ন করবে- তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে কি? ধর্মনিরপেক্ষতা যে একটা মিথ, একটা পশ্চিমা আলোকায়নজাত আরোপন, তার প্রমাণ আবার দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। আসলে তো সবধর্মই ইহজগত সামলানোর জন্যে সমাজে বিকশিত হয়েছে। পরকালবাদী ধর্মের পরকাল তো ইহকাল সামলানোর জন্যে বিমূর্ত কলকব্জা। ধর্মভিত্তিক সব রাজনীতির মর্মের দিক এটাই। ধর্ম নিজেই দেশকালনিরপেক্ষ ব্যাপার নয়। বরং বলা ভালো, সব ধর্মই সেক্যুলার। সব  ধর্মেরই দেশ-কালিক বৈশিষ্ট্য আছে। আবার  সব ধর্ম ব্যবহার করেই উচ্চবর্গ তার ক্ষমতার চর্চা করে যাচ্ছে। ধর্মের প্রশ্ন তাই শ্রেণীরও প্রশ্ন।  নানা সমাজে, নানা ঐতিহাসিকতায় বিকাশ-পরিবর্তনের ধারা খেয়াল করলে এ নিয়ে কারো দ্বিধা থাকার কথা নয়।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাই সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের ঘটনায় অবাক হওয়ার কিছু নেই। আওয়ামী লীগের মতাদর্শিক বলয়ে যারা বাস করে, এই বলয়ে বাস করার সুবিধা যারা নেয়, তারা সমাজের আপাত উদার অংশ মনে হলেও, বৈষম্যের রাজনীতিই, উচ্চবর্গের স্বার্থ রক্ষার রাজনীতিই, বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টির মতোই, তাদেরও রাজনীতি। ধর্মীয় উচ্চমন্যতা যে ক্ষমতার জন্ম দেয়, তার সঙ্গে উচ্চবর্গের ক্ষমতার বিরোধহীনতাই সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের পথকে প্রশস্ত করে। শাহরুখ-ক্যাটেরিনা-বলিউডি সংস্কৃতির কাছে আত্মসমর্পণ করা আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টির বিভিন্ন সরকার আমলে বাউল-ফকিরদের ওপর ক্ষমতার চর্চা তার প্রমাণ। যাত্রানুষ্ঠান পন্ড করা, পালাগান বন্ধ করা, বাউল গানের আসরে বোমা মারা- এসব আপাত বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে হলেও ক্ষমতার সূত্র এক।

৩.

লালন ফকির
অনেকে এটা ভেবেও অবাক যে, আজকের বাংলাদেশে যেখানে কোনো উৎসব জমে না বাউলের সুর ছাড়া, যেখানে লালন, হাসন, শাহ আবদুল করিমের গানের রমরমা ব্যবসা, যেখানে করপোরেট পুঁজি স্পন্সর করছে লালনের মৃত্যুবার্ষিকী, দোল উৎসব,  কিংবা শাহ আবদুল করিমের জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী, যার খবর না শোনার কোনো উপায় নেই সংবাদপত্র এবং টিভিতে সেসবের বিজ্ঞাপনের কারণে, যেদেশে সরকারদলীয় একজন সংসদ সদস্য নিজে ‘বাউল গানের’ শিল্পী, যেখানে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ সরকারদলীয় আদর্শের সাংস্কৃতিক মহল অনেক শক্তিশালী, সেখানে, সেই দেশে এমন ঘটনা কি করে ঘটতে পারে? দুনিয়ায় বাউল-সুফি এখন প্যারিস-লন্ডন-নিউইয়র্ক-টোকিও দাবড়ে বেড়াচ্ছে, লালন-বাউল গান শোনা যখন ‘হাই কালচার’, দেশের শাসকগোষ্ঠীর বেশ কিছু ছেলে-মেয়ে যখন ‘লালনচর্চা’ করছে, তখন বাংলাদেশের রাজবাড়ীতে এমন ঘটনা?

আবারও কেউ কেউ  বিচ্ছিন্ন ঘটনা তত্ত্বের কথা বলতে পারেন। কিন্তু তা দিয়ে কি পার পাওয়া যাবে? এই ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনায় কোনো করপোরেট পুঁজি দুঃখ পেয়েছে বলে এখনো পর্যন্ত জানা যায়নি। দেশে কত লালনগীতির, বাউলগানের শিল্পী-তারকা, দুয়েকজন বাদে তেমন কাউকে রাস্তায় এমনকি বিবৃতিতেও পাওয়া গেল না। আওয়ামী-বিএনপি ঘরানার ‘সংস্কৃতিসেবী’দের তেমন তৎপর হতে দেখা গেল না।  সংস্কৃতিবাণিজ্য বা কালচার ইন্ডাস্ট্রি, রাষ্ট্র এবং ‘সুশীল সমাজ’ এর স্বরূপ আরেক দফা বুঝিয়ে দিল রাজবাড়ীর ঘটনা।

৪.

কয়েকটা পর্বে বাউল-ফকিরদের ওপর নিপীড়নকে ভাগ করা যায়। ১. প্রাচীন ও মধ্যযুগে লোকধর্মের সঙ্গে শাস্ত্রীয় ধর্মের দ্বন্দ্ব, ২. আঠার-উনিশ শতকে সংস্কার আন্দোলনে বাউল-ফকির-বৈষ্ণব-সহজিয়া ধ্বংস, ৩. বিশ শতকে দ্বিজাতি-তত্ত্বের প্রতিক্রিয়ায় বাউল-ফকিরদের ওপর নিপীড়ন এবং ৪. ’৪৭ পরবর্তী ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশে বাউল-ফকিরবিরোধী আন্দোলন ও নিপীড়ন।

চর্যাপদ থেকে শুরু করে প্রান্তিক এসব মানুষের কথ্য ইতিহাস, পুঁথি, কাহিনী ইত্যাদিতে এসব নিপীড়নের লক্ষণ-প্রমাণ হাজির আছে। আধুনিক কালের গবেষক, যেমন আবদুল ওদুদ, কবি জসিম উদ্দিন, উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য,  ক্ষিতিমোহন সেন, আহমদ শরীফ প্রমুখের গবেষণায় সেসবের অনেক উল্লেখ আছে। শক্তিনাথ ঝা তার ‘বাউল-ফকির ধ্বংসের ইতিবৃত্ত’ বইয়ে প্রাচীনকাল থেকে অতিসাম্প্রতিককালের এসব নিপীড়নের অনেক বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছেন।

বিশ শতকের মৌলভি রেয়াজুদ্দিন ‘বাউল ধ্বংস ফতোয়া’ যেমন লিখেছেন, তেমনি হিন্দু সংস্কারক বিপিনচন্দ্র পাল, আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা দয়ানন্দ স্বরস্বতী, রামমোহন, অক্ষয়কুমার দত্ত, রামকৃষ্ণ, প্রমুখ যে বাউল-বৈষ্ণবদের ওপর প্রসন্ন ছিলেন না- তার প্রমাণ দুর্লভ নয়। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যার ‘বাউলপ্রেম’ কিংবদন্তির চেহারা নিয়েছে, তারও বাউলদের যৌনচর্চার ব্যাপারে শ্রদ্ধাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীর প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং বিপরীত মানসিকতার খবর পাওয়া যায়। উনিশ শতকের হিন্দু এবং মুসলমান সমাজ সংস্কারকরা একযোগে বাউল-ফকিরদের বিরুদ্ধে হিংসা-দ্বেষ ছড়িয়েছেন। আভিজাত্যবাদি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তারা এই বেসরা-বেদবিরোধী ‘সহজে পাগল’দের সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করতে কসুর করেননি।

১৯৪২ সালে কুষ্টিয়ায় দোল পূর্ণিমার অনুষ্ঠানে মাওলানা আফসার উদ্দিন লোকজন নিয়ে বাউল-ফকিরদের অনুষ্ঠানে হামলা করেন, বাউল-ফকিরদের দাড়ি-গোঁফ কেটে দেন। রাষ্ট্রের তরফে লালন আখড়া দখল শুরু হয় ১৯৬৩ সালে। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর মোনয়েম খাঁ লালনের সমাধিস্থলের পাশে লালন লোকসাহিত্য কেন্দ্র নামে একটি প্রতিষ্ঠান বানান পদাধিকার বলে- যার সভাপতি হন জেলা প্রশাসক। ১৯৭৬ তৎকালীন সরকার তার নাম রাখে লালন একাডেমি। ১৯৮৪ সালে এরশাদ আমলে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ফজলুল হক মিয়া সেখানে ভক্তদের প্রথাগত অনুষ্ঠানে বাধা দিয়ে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেন। লালন ভক্তদের তওবা পড়ানোর নির্দেশ দেন তিনি। সমাগত বাউল-ফকিরদের পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে আখড়া থেকে বের করে দেওয়া হয়। ১৯৯৭ সালে তৎকালীন সরকার আখড়া চত্বরে লালন কমপ্লেক্স নির্মাণ শুরু করে। সাধু-ভক্তদের সাধন-ভজনের পরিবেশ ধ্বংস করে দেওয়া হয়। আখড়ার নিকটে কালিগঙ্গা নদী ভরাট করে মঞ্চ নির্মাণ করা হয়। সাম্প্রতিককালে লালন স্মরণোৎসব এবং দোল উৎসব- দুটোই রাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় দখল নিয়েছে বহুজাতিক ফোন কোম্পানিগুলো। তারা পালাক্রমে এসব অনুষ্ঠান স্পন্সর করছে।

দেখা যাচ্ছে, প্রাচীনকাল থেকেই বাউল-ফকির-সহজিয়া-কর্তভজা-সাহেবধনী-বলাহারি-পঞ্চসখী-সুফি-বৈষ্ণবদের উচেছদ করার কাজে উচ্চবর্গ ও রাষ্ট্র এবং বেদ-শরা-অফিসিয়াল ধর্মের যোগাযোগ স্পষ্ট। এত নিপীড়নেও টিকে থাকার পর সম্প্রতি যখন বাউল-ফকির-সহজিয়া-কর্তভজা-সাহেবধনী-বলাহারি-পঞ্চসখী-সুফি-বৈষ্ণবদের সংস্কৃতির বাজার মূল্য তৈরি হয়েছে, তখন এসেছে করপোরেট পুঁজি তাকে আত্মসাৎ করতে।

৫.

বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের একটা প্রিয় শব্দবন্ধ হলো ‘আবহমান বাঙলা সংস্কৃতি’। এই কথা দিয়ে আসলে কি বুঝায়- সেই প্রশ্ন আজকে ওঠা দরকার। আবহমান বাঙলা সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য বলতে ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’, ‘সকলে মিলিয়া সুখে-শান্তিতে বসবাস করিতে থাকিল’ মার্কা কথাই বোঝানো হয়। কিন্তু ব্যাপার কি তাই? বাংলাদেশের ইতিহাসের কোন পর্যায়ে উচ্চবর্গের আদর্শিক বলয়ে থাকা মানুষজন নিম্নবর্গের বাউল-ফকির-সহজিয়াদের ওপর নির্যাতন চালায়নি? যে নিরবচ্ছিন্ন ‘শান্তি-সম্প্রীতি’র কথা বলা হয়, তার ঐতিহাসিক প্রমাণ কি? নাকি এটা ইংরাজি শিক্ষিত মধবিত্ত-উচ্চবিত্তর ভাববিলাস? যেটুকু সম্প্রীতি ছিল বা আছে, তাতে বাউল-ফকিরের অবদান কি? আবহমান বাঙলা কি শ্রেণী, লিঙ্গ, বর্ণ, জাত, ধনী-গরীব-সম্প্রদায় বৈষম্যহীন মানুষের আবাসকাল? নাকি এটা একটা বিমূর্ত কল্পনামাত্র, যা কিনা বাঙালি-জাতীয়তাবাদের ভিত্তি?  রবীন্দ্রনাথ, যিনি ‘মানুষের ধর্ম’ বক্তৃতা এবং অন্যান্য রচনার মাধ্যমে ব্রাহ্ম-ভাবাপন্ন ‘বাউল’ উপস্থাপন করেছেন ‘সোনার বাঙলা’র ইতিহাসে, যা কিনা মধ্যবিত্ত, জাতীয়তাবাদী বাঙালির অন্যতম স্মারক-প্রতীকে পরিণত হয়েছে, তা কি নিম্নবর্গ-বাউল-ফকির-সহজিয়ার প্রতিনিধি? না কি উচ্চবর্গের জাতীয়তাবাদী আদর্শিক নির্মাণ? নিম্নবর্গ কি জাতীয়তাবাদী? বাউল-ফকির-সহজিয়া কি জাতীয়তাবাদী? জাতীয়তাবাদ কি তাদের ধারণ করতে সক্ষম? জাতীয়তাবাদের মতাদর্শিক কাঠামো কি বাউল-ফকির-সহজিয়ার মতাদর্শিক কাঠামোর সঙ্গে যায়? শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে ভয় পায়। কিন্তু এসব প্রশ্নের মোকাবিলা না করে আমাদের সমাজ সামনে যাবে কি করে?

৬.

একটা বহুল প্রচলিত কথা হলো ‘বাউল-ফকিররা মানবতাবাদী’। ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই’ কিংবা লালন ফকিরের ‘মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার’- এসব গানের আক্ষরিক অর্থ এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। তা ছাড়া, বাউল-ফকির-সহজিয়া-কর্তভজারা যে কোন ধর্ম-জাত-বর্ণ-লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষের জন্য নিজেদের সাধনা চর্চার পথ খোলা রাখে, সেসব উদাহরণ ও এ ধারণা তৈরির পেছনে ভূমিকা রাখে।  কিন্তু আমাদের এই দেখার ক্ষেত্রে দর্শক যখন ইংরেজি শিক্ষিত, ইউরোপীয় আলোকায়নের ঝাপটালাগা দৃষ্টিধারী মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত, তখনি তা ‘মানবতাবাদী’ নাম পেয়ে যায়। পশ্চিমে উদ্ভূত ‘মানবতাবাদ’-এর মানুষ আর বাউল-ফকির-সহজিয়া-কর্তাভজার ‘মানুষ’ এক নয়। ইউরোপের, পশ্চিমের মানুষ হলো একজন ব্যক্তিমালিক নাগরিক। আর বাউল-ফকির-সহজিয়া-কর্তাভজার ‘মানুষ’ হলো নতুন মানুষ-সহজ মানুষ-মনের মানুষ-অধর মানুষ-সাঁইয়ের আধার। দুয়ের মধ্যে লক্ষযোজন ফাঁক। বাউল-ফকির-সহজিয়া-কর্তাভজা কেন মানুষকে ভালোবাসে, তা পশ্চিমা মানবতাবাদ দিয়ে বোঝা যাবে না। এ বিষয়ে অন্য সময় বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে। আপাতত আমরা দেখতে পাচ্ছি, পশ্চিমা উদার নৈতিকতা তথা মানবতাবাদ দিয়ে বাউল-ফকির-সহজিয়া-কর্তাভজদের উপাধি দেওয়া ঠিক নয়। যারা এটা করেন, তারা জান্তে বা অজান্তে পৃষ্ঠপোষণ মানসিকতার চর্চা করেন। এই উপর থেকে দেখা মানসিকতার কারণেই  উচ্চবর্গ বাউল-ফকির-সহজিয়া-কর্তাভজার সহজ মানুষ, মনের মানুষ প্রকল্প আমলে নেয়নি। এলিটদের কেউ কেউ হয়ত দরদী হয়েছেন, এখনো হচ্ছেন, কিন্তু সেটা বাউল-ফকির-সহজিয়া-কর্তাভজার রাজনৈতিক মর্মের প্রতি একাত্ম হয়ে নয়। পরিচয় সংকট, ফ্যাশন ইত্যাদি নানা কারণে। সহজ মানুষ, মনের মানুষ, আলেক সাঁই, মানুষ গুরু-  হল বাউল-ফকির-সহজিয়া-কর্তাভজার সেই নির্মাণ, যা প্রচলিত বেদ-শরিয়ত-প্রথা-পদ্ধতি-আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব মানব চরিত্রে পাওয়া যায় না। ব্যক্তিমালিকানার সমাজ ও সংস্কৃতি, সম্প্রদায়-জাত-বর্ণ-লিঙ্গ বৈষম্যমূলক সমাজ ও সংস্কৃতি যেই মানুষের নিত্যঅবস্থান অসম্ভব, সেই মানুষের ডাকে তারা জাত-লিঙ্গ-বর্ণ-সম্প্রদায়ের বাধা ভেঙে নিজের এবং সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটাতে চায়। রূপান্তরের এই আকাঙ্ক্ষায় পবিত্রতা, মর্যাদা, সম্মান, রুচি, স্বাদ, সৌন্দর্যবোধ, সদর-অন্দর, পাবলিক-প্রাইভেটের নতুন মানদন্ড নিয়ে হাজির হয়। নতুন মূল্যবোধ হাজির হয়। সমাজ আগায়। তাই বাউল-ফকির-সহজিয়া র‌্যাডিক্যাল। বৈপ্লবিক। গণতান্ত্রিক। দাস-সামন্ত সমাজে গড়ে ওঠা শাসকশ্রেণীর ধর্মগুলোর চেয়ে তো বটেই। বাউল-ফকির-সহজিয়া-কর্তভজা-সাহেবধনী-বলাহারি-পঞ্চসখী-সুফি-বৈষ্ণবদের সঙ্গে বেদ-শাস্ত্র-শরা পন্থীদের বিরোধ উচ্চবর্গের কায়েমি স্বার্থের সঙ্গে নিম্নবর্গের, তাদের স্বার্থের ও আদর্শের বিরোধ। এই  নিম্নবর্গ উচ্চবর্গকে শাসনের আওতায় আনতে যায়নি। উচ্চবর্গই এই  নিম্নবর্গকে শাসনের আওতায় আনতে যাওয়ায় বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে। সে বিরোধ ইংরেজ এবং দেশী- সব সাহেবের সঙ্গেই। নিম্নবর্গের স্বার্থ হলো উচ্চবর্গের কায়েমি স্বার্থের বাইরে গিয়ে নিজের এবং সমাজের মানবিক রূপান্তর। নতুন মানুষ, নতুন সমাজ নির্মাণের লড়াই। উচ্চবর্গের সৃষ্ট ধর্ম, জীবনব্যবস্থা যা তাকে দিতে পারেনি। যেহেতু  নিম্নবর্গকে  উচ্চবর্গের দেওয়ার মতো কোনো গ্রহণযোগ্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রস্তাবনা নেই, এবং যেহেতু নিম্নবর্গেরই বরং তা আছে এবং তা কায়েমি স্বার্থের প্রতি হুমকি, তাই উচ্চবর্গ যে কোনো সুযোগে বাউল-ফকির-সহজিয়া-কর্তভজা-সাহেবধনী-বলাহারি-পঞ্চসখী-সুফি-বৈষ্ণবের ওপর চড়াও হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ অঞ্চলে বাউল-ফকির-সহজিয়া-কর্তভজা-সাহেবধনী-বলাহারি-পঞ্চসখী-সুফি-বৈষ্ণবদের সঙ্গে উচ্চবর্গের বিরোধ তাই শ্রেণীবিরোধ। শ্রেণীসংগ্রামের বিশেষ রূপ।

নিম্নবর্গ কিংবা বাউল-ফকির-সহজিয়া-কর্তভজা-সাহেবধনী-বলাহারি-পঞ্চসখী-সুফি-বৈষ্ণবরা যে একহারা একটি শ্রেণী, তা বলা হচ্ছে না। আমরা দেখতে চেষ্টা করছি, সমাজের নিম্নবর্গের আপাত আদর্শিক মুক্তাঞ্চল গঠনকারী এই ধারার সাধনার রাজনৈতিক দিক ও সমাজে তার প্রতিক্রয়া। এই নিম্নবর্গ একটা শ্রেণীর পরিধির মধ্যে  বাস করে। যেই শ্রেণী এখনো আত্মরূপে কর্তা হয়ে ওঠেনি বলে রাষ্ট্র তার নয়, শাসন তার নয় কিংবা লড়াইও তার শ্রেণীর নামে নয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বাউল-ফকির-সহজিয়া-কর্তভজা-সাহেবধনী-বলাহারি-পঞ্চসখী-সুফি-বৈষ্ণব প্রান্তিকেরও প্রান্তিক। তাই তাকে নিয়ে ব্যবসা করা যায়। তার ওপর নিপীড়ন করা যায়। তার প্রতি দরদ দেখানোর তামাশাও করা যায়।

৭.

ভিক্ষার প্রসঙ্গ এসেছিল। কথাটার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মাত্রা আছে। সাধক বাউল-ফকিরদের একটা বড় অংশের সাধনার একটা বড় দিক হচ্ছে মাধুকরী বা ভিক্ষাবৃত্তি। এটা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, এই ধারার জন্ম-বিকাশ হয়েছে একটা নির্দিষ্ট সমাজ-অর্থনৈতিক বাস্তবতায়, আরো নির্দিষ্ট করে বললে কৃষিভিত্তিক সমাজে, যাতে নিম্নবর্গের একধরনের কর্তৃত্ব ছিল। যে সাবেকি-সনাতনি উৎপাদন সম্পর্ক এই ধারার বিকাশকে সম্ভব করেছিল, তা আর বাংলাদেশ তথা এই উপমহাদেশে নেই। নিম্নবর্গের সাংস্কৃতিক উৎপাদন ও বিকাশের সনাতনি প্রক্রিয়াও তাই আর হাজির নেই। যা এখনো টিকে আছে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে, তা শুধু নবতর বিকাশের সম্ভাবনার জোরেই টিকে আছে। কিন্তু এই সম্ভাবনা বাস্তব রূপ লাভ করবে কি করবে না, তা নির্ভর করছে নিম্নবর্গের এই সম্ভাবনার দিকগুলো নিম্নবর্গ নিজে এবং সমাজের গণতান্ত্রিক অংশ আমলে নেয় কিনা, তার পর্যালোচনা ও সম্ভাবনার দিকগুলো চর্চা করতে সক্ষম হয়ে ওঠে কি-না তার ওপর। আমরা যদি ঔপনিবেশিক, পশ্চিমা আধুনিকতাবাদী, আভিজাত্যবাদী, আধিপত্যবাদী  সংস্কৃতির আগল ভেঙে একটা গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের দিকে যেতে চাই, তবে আমাদের নিজস্ব এই সম্ভাবনাময় গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক উপাদান থেকে নেওয়ার আছে অনেক কিছু। তার কোনো যত্ন-প্রযত্ন কি আমরা করব না?


আমার পছন্দের "বাউলিয়ানা" ব্লগটি দেখতে এখানে ক্লিক্‌ করুন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন