বৃহস্পতিবার, ২ জুন, ২০১১

অপরাজেয় কিংবদন্তী কবি- নাজিম হিকমত

আজ কবি নাজিম হিকমতের প্রয়াণ দিবস।

১৯৬৩ সালের ৩ জুন হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে এই মহান কবি মস্কোয় মৃত্যুবরণ করেন।

হে মৃত্যুহীন কবি, সশ্রদ্ধ সংগ্রামী অভিবাদন।

নাজিম হিকমতের পৃথিবী

বিনায়ক সেন | তারিখ: ০৩-০৬-২০১১


নির্বাসিত নাজিম

‘নাজিমের নীল চোখে ওরা বৃথাই খুঁজে ফিরবে ভয়’ এমন একটি লাইন আমাদের যৌবনের আকাশে তারকাখচিত হয়ে গিয়েছিল। অনুবাদক ছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ১৯৫২ সালে বেরুনো বইয়ের ভূমিকায় তিনি জানিয়েছিলেন যে, যদিও বেশিরভাগ কবিতাই ইংরেজি পাঠ থেকে নেওয়া, কিছু কিছু কবিতা ফরাসি থেকেও অনূদিত। ফরাসি থেকে অনুবাদের কাজে তিনি গীতা মুখোপাধ্যায় ও (পরবর্তীতে নিম্নবর্গের ইতিহাস-খ্যাত) রণজিৎ গুহের সাহায্য নিয়েছেন। পরবর্তীতে তাঁর স্মৃতিচারণায় পড়েছি, (১৯৫১ কি ’৫২ সালে কলকাতায়, জানি না কী করে, আমাদের বন্ধু ডেভিড কোহেনের হাতে এসেছিল নাজিম হিকমতের একগুচ্ছ কবিতার ইংরেজি তর্জমা। ইংরেজি খুব উচ্চাঙ্গের নয়। তবু পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এখন জানা যাচ্ছে ইংরেজিতে নাজিম হিকমতের কবিতার প্রথম সংকলন বের হয় কলকাতা থেকেই—পরিচয় প্রকাশনী থেকে ১৯৫২ সালে। ইংরেজিতে এর আগে নাজিম হিকমতের কোনো কাব্য-সংকলন প্রকাশ পায়নি। কেন এ রকম একটি সংকলন আর সব জায়গা থাকতে কলকাতা থেকেই প্রকাশিত হতে হবে সেটাও খানিকটা রহস্যজনক। এর পেছনের কার্য-কারণ সূত্র এখন ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে।

গত শতকে পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলছিল ম্যাকার্থিবাদের দাপট। সর্বত্র কমিউনিজমের চিহ্ন খুঁজে বেড়াচ্ছেন সিনেটর ম্যাকার্থি—‘আন-আমেরিকান’ কর্মকাণ্ডের জন্য হয়রানির মুখোমুখি হচ্ছেন একের পর এক কবি-নাট্যকার-শিল্পী-বিজ্ঞানীরা। হলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও বাদ যাচ্ছেন না। এদের মধ্যে ছিলেন লেখক আর্থার মিলার, এলিয়া কাজান, লিলিয়ান হেলম্যান, হাওয়ার্ড ফাস্ট, ডরোথি পার্কার, ইরউইন শ, ল্যাংস্টন হিউজ, সাংবাদিক উইলিয়াম শীরার, গায়ক পিট সিগার, নোবেল-জয়ী বিজ্ঞানী লাইনাস পাওলিং প্রমুখ। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা মুক্তচিন্তার নামে দেশদ্রোহী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন। শুধু তা-ই নয়, এসবের মধ্য দিয়ে কার্যত তাঁরা পরিণত হয়েছেন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সমর্থকে। এ রকম বৈরী পরিবেশে কমিউনিস্ট কবি নাজিম হিকমতের অনুবাদ আমেরিকায় প্রকাশ করা সহজ ছিল না। নাজিমের অনুবাদ যাঁরা সেদিন করেছিলেন (তাঁদের নাম যথাক্রমে নিলুফার ও রোসেট) তাঁদেরকেও ছদ্মনামের আশ্রয় নিতে হয়। ফলে অনুবাদক হিসেবে ছাপা হয় আলি ইউনূসের নাম। ‘আলি’ খুবই প্রচলিত নাম, আর ‘ইউনূস’ এসেছিল ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীর কবি ইউনূস এমরে-র থেকে। অনুবাদকেরা জানতেন, দরবেশ কবিকুলের মধ্যে রুমি ছাড়া এমরের কবিতা নাজিমের খুব প্রিয় ছিল। যা হোক, অনুবাদ তো হলো, কিন্তু ছাপানো নিয়ে সমস্যা গেল না। এই সময়ে নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভারত থেকে আসা কিছু শিক্ষার্থী’ (ওদের নাম এখনো জানা যায়নি এবং ওদের অধিকাংশ বাঙালি হলে বিস্ময়ের কিছু নেই) নাজিমের এই অনুবাদ হাতে পান। পড়ে তাঁরা এতই বিমোহিত হয়ে পড়েন যে, এই মহার্ঘ বস্তু দ্রুত জনসমক্ষে আনার জন্য পাণ্ডুলিপির একটি অনুলিপি পাঠিয়ে দেন কলকাতায়। এভাবেই ‘পরিচয়’ প্রকাশনী থেকে (হয়তো ডেভিড কোহেনের হাত ঘুরেই) ১৯৫২ সালে ৩৫টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় ইংরেজিতে ‘নাজিম হিকমতের নির্বাচিত কবিতা’র প্রথম সংকলন।

যেহেতু নাজিম আজীবন কবিতা লিখেছেন তাঁর মাতৃভাষা তুর্কিতে, তাঁর কবিতার অনুবাদ কিছুটা দেরিতে হলেও পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুবাদ হয়েছে রুশ ভাষায়, তার পরে ফরাসিতে এবং গত দুই দশকে সবচেয়ে বেশি হারে ইংরেজিতে। তাঁর কবিতার পাঠকের সংখ্যা ইংরেজি-জানা বৃত্তে এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে যে, তাঁর স্বদেশীয় মরমী কবি জালালুদ্দিন রুমীর মতো নাজিম হিকমতও আধুনিক ইঙ্গ-মার্কিন সাহিত্যের ভুবনে এখন একটি অতি প্রিয় নাম। অন্তত দশটি কাব্য-সংকলন, একাধিক জীবনী গ্রন্থ, স্মৃতিচারণা ও চিঠিপত্র নিয়ে নাজিমিয়ানা এখন ইংরেজিতে অনুবাদের একটি বিশেষ শাখায় পরিণত হয়েছে। নিজের কবিতার অনুবাদ নিয়ে ১৯৬১ সালের দিকে লেখা একটি কবিতায় নাজিম লিখেছিলেন, ‘তিরিশটি-চল্লিশটি ভাষায় আমার লেখা প্রকাশিত, কিন্তু আমার তুরস্কে, আমার তুর্কি ভাষায় আমার লেখা নিষিদ্ধ।’ ১৯৫১ সালের ২৫ জুলাই তুরস্কের সরকার তাঁর নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেয়। ২০০৯ সালে মৃত্যুর ৪৬ বছর পর সেই নাগরিকত্ব ফিরে পান তিনি। এখন ইস্তাম্বুলের এশিয়া অংশে চালু হয়েছে নাজিমের প্রিয়তমা স্ত্রীর নামে ‘পিরাইয়ে কাফ্যে’, খোলা হয়েছে নাজিম হিকমত আকাদেমি, সেখানে প্রতিদিন ভিড় করে সংস্কৃতিমনা সাধারণ মানুষ।

এক নিঃসঙ্গ বিপ্লবী
১৯০২ সালে তাঁর জন্ম তুরস্কের ছোট্ট শহর আলেপ্পোয়। যেখানে জন্ম সেখানে কখনো আর ফিরে যাননি। বলতেন, ‘ফিরে যেতে ভালোবাসি না আমি।’ তারপরও ফিরে গিয়েছিলেন মস্কোতে—একবার নয়, বার তিনেক। প্রথমবার ১৯২১ সালে—মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। দ্বিতীয়বার ১৯২৮ সালে—তুরস্কের গোপন কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে। তৃতীয়বার ১৯৫১ সালে—জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ১৯৬৩ সালে মস্কোতেই তাঁর মৃত্যু। ঘর থেকে প্রতিদিনের মতো বের হয়েছেন সকালের পত্রিকা আনতে, পত্রিকাটা হাতে নিয়েই ঢলে পড়েন আকস্মিকভাবে। অনেক দিনের বুকের অসুখ নিয়ে এর বছর কয়েক আগেই তিনি লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা—‘এঞ্জাইনা প্যাক্টোরিস’। ১৯২১ সালে যখন মস্কোয় পড়তে যান তখন তাঁর বয়স ছিল ১৯ বছর। ১৪ বছর বয়স থেকে কবিতা লিখেছেন। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘কেউ কেউ জানে উদ্ভিদ জগতের রহস্য, কেউ কেউ জানে মাছেদের ভুবন, কেউ বা জানে তারাদের নাম, আর আমি জানি সব ধরনের নিঃসঙ্গতার ভাষা।’

রেজিস দেব্রে এক সময়ে চে গুয়েভারার বলিভিয়ার অভিযানের সঙ্গী ছিলেন (এবং পরবর্তীতে হয়েছিলেন ফ্রান্সের সোশ্যালিস্ত প্রেসিডেন্ট মিতেরাঁর উপদেষ্টা)।
তিনি নাজিমের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন প্যারিসে। বিশ্ব জনমতের চাপে তুরস্কের জেল থেকে তিনি সবে ছাড়া পেয়েছেন। ‘কমিউনিস্ট পার্টিতে এলেন কীভাবে’—এই প্রশ্নের উত্তরে নাজিম বলেছিলেন: ‘পার্টি করে মানুষ সাধারণত দুই কারণে। এক, তারা আসে মেহনতি শ্রেণীর থেকে। মেহনতি শ্রেণীর পার্টিতে খেটে-খাওয়া মানুষেরা আসবে সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আমার জন্য এটা প্রযোজ্য নয়। আমার পরিবার ছিল আমলাদের পরিবার (নাজিমের নানা ছিলেন অভিজাত শ্রেণীর “পাশা”—সুলতানদের দরবারে এক উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী)।
দুই, আর পার্টিতে যারা আসে, তারা আসে বুদ্ধির তাড়নায়—বই পড়ে, চিন্তা করে, মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে। কিন্তু আমি এসেছিলাম হূদয়ের টানে। ১৯ বছর বয়সে যখন মস্কোয় যাই আমার একমাত্র ইচ্ছে ছিল লেনিনের সঙ্গে দেখা করব, দেখা করে বলা, “আপনার সাফল্যের গোপন চাবিকাঠি আমাকে বলে দিন। আপনি কী করে বিপ্লব সমাধা করলেন তার রহস্য আমাকে বলুন।” আসলে আমার ইচ্ছে ছিল, লেনিনের কাছ থেকে এরকম কোনো গোপন চাবিকাঠি পকেটে নিয়ে আমি নিজ দেশ তুরস্কে ফিরে যাব। তারপর “বিপ্লব করে” গরিবী ঘুচাব দেশের মানুষের।’ লেনিনের সঙ্গে অবশ্য সরাসরি কখনো দেখা হয়নি নাজিমের। কিন্তু ১৯২৪ সালে লেনিন যখন মারা গেলেন তখন সেই অগণন শোক মিছিলের মধ্যে তিনিও অংশ নিয়েছিলেন।
মস্কোয় থাকতেই কমিনটার্নের সংস্পর্শে গড়ে ওঠা তুরস্কের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে নাজিমও জড়িয়ে পড়েন। পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মুস্তফা সুফির মৃত্যু ঘটে কিছুটা রহস্যজনকভাবে দেশে ফেরার পথে সমুদ্রে জাহাজডুবি হয়ে। লেনিনের মৃত্যুর কিছুদিন পরেই ১৯২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে নাজিম ফিরে যান তুরস্কে। এরই মধ্যে তুরস্কে খেলাফতের অবসান হয়েছে, রিপাবলিক ঘোষিত হয়েছে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন মোস্তফা কামাল (পরে আতাতুর্ক অভিধা পেয়েছেন)।
কমিউনিস্টদের সঙ্গে প্রথমদিকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি নিয়ে চলছিল আতাতুর্কের রিপাবলিকান পার্টি। কিন্তু সে অবস্থা অল্প দিনেই বদলে যায়। নিষিদ্ধ হয় ‘প্রগ্রেসিভ রিপাবলিকান পার্টি’ (প্রকাশ্য সংগঠন ছিল এটি বামপন্থীদের)।
কমিউনিস্ট পার্টি চলে যায় আন্ডারগ্রাউন্ডে। তুরস্কে ফিরে গিয়ে নাজিম প্রকাশ্যে কাজ করেছেন প্রথমে বিভিন্ন পত্রিকায়, উদ্দেশ্য—লেখালেখি। আবার গোপনে যুক্ত থেকেছেন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে—ইস্তাম্বুলে পার্টির গোপন কংগ্রেসেও যোগ দিয়েছিলেন। ১৯২৫ সালে গোপন ইশতেহার বিলির দায়ে তুরস্কের আদালত তাঁকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেয় আত্মগোপনরত অবস্থায়। নাজিমকে আবারও দেশ ছেড়ে কৃষ্ণসাগর পাড়ি দিয়ে চলে আসতে হয় সোভিয়েত ইউনিয়নে। ১৯২৬ সালের অক্টোবরে প্রবাসে থাকাকালীনই সাধারণ ক্ষমতায় রাজবন্দীদের মামলা তুলে নেওয়া হলে এর আগেকার ১৫ বছরের কারাদণ্ডাদেশ প্রত্যাহার করা হয় নাজিমের ওপর থেকে। ১৯২৮ সালে নাজিম তুরস্কে ঢুকতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন, তিন মাস জেল খেটে আবার বেরিয়ে আসেন। এর পর থেকে তুরস্কেই ছিলেন তিনি কিন্তু বিরতিহীনভাবে ‘আজ গ্রেপ্তার, কাল ছাড়া আবার পরশু গ্রেপ্তার’ এরকম চক্রের মধ্য দিয়ে। এ সময়ের আতাতুর্ক শাসনের লক্ষণীয় দিক ছিল বামপন্থীদের কোণঠাসা করার পাশাপাশি আধুনিকায়নের প্রচেষ্টা। য়ুরোপের অনেক দেশের আগেই ১৯৩০ সালে তুরস্কের মহিলারা পায় ভোটাধিকার, স্থানীয় পরিষদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগও পায় তারা। শরিয়াপন্থীদের সঙ্গে রিপাবলিকপন্থীদের রাজনৈতিক লড়াইও চলতে থাকে। কিন্তু নাজিমকে ক্রমাগত বিব্রত হতে হয় একের পর এক মামলায়। নাজিম নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন কি-না সেটা এখানে বিবেচ্য বিষয় ছিল না। গোপন বনাম প্রকাশ্যে কাজ নিয়ে পার্টি মধ্যে মতদ্বৈততা ছিল। নাজিম ছিলেন প্রকাশ্যে কাজের পক্ষে এবং এ কারণে ১৯৩২ সালে পার্টি থেকে তাঁকে বহিষ্কারও করা হয়। কিন্তু নাজিম নিজেই ছিলেন মার্কসবাদী পার্টির জীবন্ত প্রতীক। ফলে পার্টির সদস্যপদ হারালেও তাঁর বিরুদ্ধে হয়রানি মামলা ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। এখন জানা যাচ্ছে যে, স্বয়ং আতাতুর্ক এবং তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুক্রু কায়া নাজিমের কবিতা গোপনে ভালোবাসতেন বলে বামপন্থী সত্ত্বেও তাঁকে দীর্ঘদিনের জন্য কারারুদ্ধ করে রাখতে চায়নি তুরস্কের সরকার। ছোট ছোট মামলায় জড়িয়ে তাঁকে ব্যতিব্যস্ত রাখাই ছিল দমন-পীড়নের উদ্দেশ্য। একটি উদাহরণ দিলে রাষ্ট্রের এই কূটকৌশলটি পরিষ্কার হবে।

১৯৩১ সালের ৬ মে নাজিম গ্রেপ্তার হন লেখার জন্য; ছাড়া পান ওই বছরের ১০ মে। ১৯৩৩ সালে ১৮ মার্চ আবার গ্রেপ্তার হন লেখার কারণে। এবার রাষ্ট্রীয় কৌঁসুলী সরকারকে উৎখাত করার জন্য তাঁর মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দাবি করে। ওই বছরের ২৯ জুলাই ছয় মাসের কারাদণ্ড পান। ওই একই বছরের ২৭ আগস্ট তাঁকে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় ব্যঙ্গ কবিতা লেখার জন্য। ১৯৩৪ সালের ৩১ জানুয়ারি তাঁকে দেওয়া হয় আরও পাঁচ বছরের কারাদণ্ড সম্পূর্ণ অন্য একটি মামলায়, যদিও সেটাও লেখারই জন্য। ১৯৩৪ সালের ৪ আগস্ট রিপবালিকের এক দশক পূর্তি উপলক্ষে নাজিম আবারও সাধারণ ক্ষমায় ছাড়া পান। এসব ডামাডোলের মধ্যেই আবার তাঁর কয়েকটি কবিতা সরকারি অনুমোদনে কলেজের পাঠ্যবইয়ে স্থান পায়। ইতিমধ্যে স্পেনে শুরু হয়ে গেছে ফ্রাঙ্কোবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন। এই অবস্থায় ১৯৩৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর নাজিম আবারও গ্রেপ্তার হন। ১৯৩৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জামিনে ছাড়া পান। এসবের ফাঁকে ফাঁকে তাঁর কবিতা ছড়িয়ে পড়েছে তুরস্কের সীমানার বাইরে। সুররিয়ালিস্তরা প্যারিসে তাঁর কবিতার অনুবাদ প্রকাশ করেছে এরই মধ্যে। কলম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানি তাঁর কবিতার ওপরে গানের রেকর্ড বের করেছে। নাজিম নিজে বিভিন্ন নাটক লিখে মঞ্চস্থ করাচ্ছেন, ফাঁকে ফাঁকে লিখছেন চিত্রনাট্য এমনকি ১৯৩৭ সালে নিজেই নির্মাণ করেছেন এক শিল্পসম্মত চলচ্চিত্র ‘সূর্যের দিকে’ (এর আগে ইস্তাম্বুল সিম্ফনি ও বুর্মা সিম্ফনি নামে আরও দুটি তথ্যচিত্রও তাঁর পরিচালনায় নির্মিত হয়েছে।) রাশিয়ায় তখন চলছে কুখ্যাত মস্কো শো-ট্রায়াল—লেনিনের সহকর্মী বুখারিন রাদেক, জিনোভিয়েভ কামেনেভদের বিরুদ্ধে। কাকতালীয়ভাবে একই সময়ে প্রায় একইভাবে সম্ভাব্য-অসম্ভাব্য কারণ দেখিয়ে মায়াকোভস্কি-মেইয়ের হোল্ডের সহকর্মী নাজিমের বিরুদ্ধে তুরস্কেও চলছে প্রহসন-বিচার। ১৯৩৮ সালের ১৭ জানুয়ারি শেষবারের মতো গ্রেপ্তার হলেন নাজিম হিকমত। এবার তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে ২৮ বছর চার মাসের দীর্ঘ কারাদণ্ড। হয়তো আতাতুর্ক বেঁচে থাকলে এমনটা হতো না। কিন্তু আতাতুর্ক মারা যান ১৯৩৮ সালের ১০ নভেম্বর। ফলে ওই দণ্ডের আর রদবদল হয়নি।

নাজিমের মতো আর কোনো কবিকে বিংশ শতাব্দীতে এতো ক্ষান্তিহীন ভাবে আইনি মামলা দিয়ে হেনস্তা করা হয়নি, এতবার গ্রেপ্তারও করা হয়নি, সম্ভবত আর কাউকে। যদি সব কারাদণ্ডের আদেশ বহাল থাকত— ইলিয়া এরেনবুর্গ হিসাব করে বের করেছেন—তাহলে তাঁকে জেলের মধ্যে কাটাতে হতো এক দুটো বছর নয়, এক দুই দশকও নয়—মোট ৫৬ বছর। এতটাই বিপজ্জনক ছিলেন ‘সিস্টেমের জন্য’ নীলচক্ষু সোনালী চুলের কবি নাজিম হিকমত!

মায়াকোভস্কি, বোদলেয়ার ও রুমি
কবিতায় যে নন্দনতত্ত্ব নাজিম প্রবর্তন করেছিলেন তার জন্য তিনি অকুণ্ঠ ঋণ-স্বীকার করেছেন তিনজনের কাছে। একজন রুশ কবি (কারো কারো মতে, ‘অক্টোবর বিপ্লবের কণ্ঠস্বর’) ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি। দ্বিতীয় জন, আধুনিক ফরাসী কবিতা যার হাতে জন্ম সেই কিংবদন্তীসম শার্ল বোদলেয়ার। আর তৃতীয় জন, নিজ দেশের—‘মরমী কবি’ জালালুদ্দিন রুমি। মায়াকোভস্কির প্রভাব পড়েছিল তার প্রথম দিকের কবিতায়। এ নিয়ে অনেকেই লিখেছেন যে, সিঁড়ি-ভাঙা মাত্রায় মুক্ত ছন্দে নাজিমও তার কবিতার লাইন সাজিয়েছেন। মায়াকোভস্কির মতই তার কবিতায় দেখা দিত নানা অপ্রত্যাশিত বাঁক, তার কবিতার তীর্যক সুরও একই উৎস থেকে প্রাপ্ত। নাজিমের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল মায়াকোভস্কির। উভয়ে একই মঞ্চ থেকে কতবার কবিতা-পাঠ করেছেন উদাত্ত গলায়। বিশের দশকের শুরুতে মস্কো তখন হয়ে উঠছে নব-নিরীক্ষা আন্দোলনের কেন্দ্র। কবিতা, নাটক, সিনেমা, উপন্যাস-সর্বত্র চলছে নতুন প্রলেতারীয় কালচারকে চিনে-নেওয়ার পালা। ১৯২১-২৪ ও পরে ১৯২৫-২৮ কালপর্বে নাজিমের কবি-জীবন এই নব-নিরীক্ষা আন্দোলনৈর পরিবেশে অগ্রসর হয়েছে।

একবার মায়াকোভস্কি ও নাজিম একই মঞ্চে কবিতা পড়বেন। হাত-পা নেড়ে মায়াকোভস্কি তাঁর কবিতা উচ্চগ্রামে পড়ে গেলেন। এরপর নাজিমের পালা। স্বভাবতই কিছুটা স্নায়ুর চাপে ছিলেন। মায়াকোভস্কি তাঁকে বললেন, ‘দ্যাখো বাপু, তুমি তো পড়বে কবিতা তুর্কি ভাষায়, এখানকার রুমী দর্শকেরা সেসবের বিন্দু-বিসর্গ জানে না। সুতরাং মনের সুখে তুমি পড়ে যাও। দেখবে প্রচুর হাত তালি পাবে।’

এরেনবুর্গ তার স্মৃতিকথায় বলেছেন, মায়াকোভস্কি নয় বরং নাজিমের কবিতার নিকটতম তুলনা হতে পারে কেবল পল এলুয়ারের কবিতা। সেটা সম্ভবত এলুয়ারের ওলগার সাথে নাজিমের কবিতায় পিরাইয়ের বহুল উল্লেখের কথা ভেবে লেখা। এলুয়ার ও নাজিম উভয়েই অবিশ্রান্তভাবে নিজেদের প্রিয়তমাসুদের প্রসঙ্গ এনেছেন কবিতায়। নাজিম নিজে অবশ্য বলেছেন অন্য কথা। মায়াকোভস্কির মত কংক্রিট কিছুটা কর্কশ গদ্য-ছন্দের চেয়ে আরো অনেক মৃদু-স্বরের কবিতা তার। জেলপর্বের কবিতায় আসলেই নাজিমের স্বর অনেক খাদে নেমে গিয়েছিল—যেন নিজের কথা অন্য কারো জন্যে নয়, কেবল তার নিজের জন্যে লেখা অথবা তার প্রিয়তমার মুখোমুখি বসে স্বাগত উচ্চারণে শোনানোর জন্যে লেখা।

দেব্রে তাঁর সাক্ষাৎকারে নাজিমকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি কার জন্যে কবিতা লেখেন, নাজিমের উত্তর ছিল সোজাসাপ্টা: ‘কবিতাকে আগে কবিতা হয়ে উঠতে হবে। একজন বিপ্লবী, সমাজতান্ত্রিক, বামপন্থী, দায়বদ্ধ কবি (যে-নামেই তাকে চিহ্নিত করুন না কেন) তিনি হবেন এক সদা-সক্রিয় কবি: তিনি শুধু মানুষের হূদয়ের কথাই বলবেন না, হূদয়কে তিনি একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে চালিত করবেন।.. লেনিন যখন বেঁচে ছিলেন, সেই সময়ের মস্কোয় মায়াকোভস্কি ও ইয়েসেনিনের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। সেসময় বড় বড় জমায়েতে কবিতা পড়া হত। আমার তখন মনে হয়েছিল, আমার দেশেও তো কবিরা যুগ যুগ ধরে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ঘুরে ঘুরে জনগণের সামনে কবিতা পাঠ করেছেন। জেলে যাওয়ার আগে আমিও কবিতা লিখতাম বহু শ্রোতার সামনে দাঁড়িয়ে কবিতা পড়ব বলে। পরে যখন জেলে থাকতে হল অনেক দিন ধরে, তখন থেকে আমার স্বরও নেমে যেতে থাকল। আমার শ্রোতা বলতে কেউ ছিল না, বা থাকলেও এক-দুজন মাত্র। একজনকে শোনাতে পারলেও আমার মনে হত তখন এর মধ্য দিয়েই আমি পৃথিবীর সব মানুষের কাছে যেতে পারছি’।

নাজিম তার এক কবিতায় একবার নিজেকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘বলো, হিকমত-পুত্র, কোন শহরে তুমি মরতে চাও’? উত্তর দিয়েছিলেন এই বলে, ‘আমি মারা যেতে চাই ইস্তাম্বুলে, মস্কোয় এবং প্যারিসেও।’ অন্যত্র বলেছেন, ‘আমার মৃত্যুগুলোকে আমি পৃথিবীর উপরে বীজের মত ছড়িয়ে দিয়েছি, এর কিছু পড়েছে ওদেসায়, কিছু ইস্তাম্বুলে, আর কিছু প্রাগে। সবচেয়ে যে-দেশকে আমি ভালোবাসি সেটি হচ্ছে পৃথিবী। যখন আমার সময় আসবে, আমাকে পৃথিবী দিয়ে মুড়ে দিও’।
অনেক শহরের মধ্যে প্যারিস যে মাঝে-মাঝেই ঘুরে-ফিরে আসে তার কবিতায় তার একটা প্রধান কারণ ছিলেন বোদলেয়ার। ‘প্যারিস স্প্লীন’ থেকে গদ্য-ছন্দের এক নতুন সুষমা তিনি আহরণ করেছিলেন। ফরাসি ভাষায় দখল থাকায় মূলের স্বাদ নিতে বাধা হয়নি তারা নিত্য-নৈমিত্তিক জীবনের নানা খুঁটিনাটি কবিতার অনুষঙ্গ হিসেবে উঠে এসেছিল তার কবিতায় বোদলেয়ারের প্রেরণাতেই। অন্যত্র তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘আমি কবিতা লিখতে শুরু করি পনেরো বছর বয়সে। ঐ সময়ে ভালোবাসা ও মৃত্যু কবিতাকে আচ্ছন্ন করে থাকে। বাবার দিক থেকে আমি একেবারেই প্রাচ্যপন্থী, আর মা’র দিক থেকে পুরোপুরি য়ুরোপীয়। আমি বোদলেয়ার দ্বারা পুরোপুরি আচ্ছন্ন দিলাম, কিন্তু আমার দেশের দরবেশ কবিকুলও আমার চৈতন্যে প্রভাব ফেলেছিলেন। আমি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিশ্রণে তৈরি’।

প্যারিসের কোন জিনিসটি সবচেয়ে ভালো লাগে? সে হচ্ছে প্যারিসই। এখানে কি তোমার দেখা হয়েছে তোমার কমরেডদের সঙ্গে? হ্যাঁ, আমি দেখেছি নামিক কামাল, জিয়া পাশা, মুস্তফা সুফি ওদের। আমি দেখেছি আমার তরুণী বয়সের মাকে—তিনি ছবি আঁঁকছেন, ফরাসিতে কথা বলছেন অনর্গল— পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নারী তিনি। বলো তো. প্যারিসকে কেমন দেখায়? তাকে দেখায় প্যারিস বাসীর মতো। বলো, আদমের পুত্র, এবারে বলো—তুমি কি প্যারিসকে বিশ্বাস করো, হ্যাঁ, আমি প্যারিসকে বিশ্বাস করি।’ তাঁর প্রিয় বন্ধু লুই আরাগঁ, পল এ লুয়ার, ত্রিস্তান জারা, পাবলো পিকাসো—এদের স্মৃতি প্যারিসকে ঘিরেই। এ কারণেই অন্যত্র বলেছেন, ‘আমি বেঁচে থাকব আরাগঁ-র কবিতায়, আমি বেঁচে থাকব পিকাসোর শাদা কবুতরে, আমি বেঁচে থাকব মার্সাইয়ের ডক শ্রমিকদের মধ্যে।’ শহর নিয়ে এরকম অনর্গল প্রশস্তি-গাঁথা আর কোথাও নেই: নেরুদা করেননি তার মান্টিয়াগো নিয়ে, কার্দেনাল করেননি তাঁর মানাগুয়া নিয়ে, পুশকিন করেননি তার সেই পিটার্সবাগ নিয়ে। নাজিম নিজেও আর কোনো শহরকে নিয়ে এতটা প্রেমময় কাব্য লেখেননি।

সম্পাদক ও প্রকাশক: মতিউর রহমান
সিএ ভবন, ১০০ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫
ফোন : ৮১১০০৮১,৮১১৫৩০৭-১০, ফ্যাক্স : ৯১৩০৪৯৬
ই-মেইল :info@prothom-alo.com




অপরাজেয় কিংবদন্তী কবি- নাজিম হিকমত


তুর্কি কবি নাজিম হিকমতের মৃত্যু দিবস ৩ জুন। এই উপলক্ষে তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

ফ্লোরা সরকার ● শিল্প যখন মনের গহীন থেকে ওঠে আসে তখন তা হয় সৃষ্টি আর যখন হৃদয়ের রক্তক্ষরণ থেকে ওঠে আসে তখন সেই শিল্প শুধু সৃষ্টিশীলই হয় না তা ঘটায় বিপ্লব। বিপ্লবী শিল্পী শুধু নিজের দেশেই নয়, তার সৃষ্টি ছড়িয়ে দেন পৃথিবীর নানা দেশে, নানা প্রান্তে। মৃত্যুর পরেও তিনি থাকেন অপরাজেয়, নাজিম হিকমত- তুরস্কের এমনই এক বিপ্লবী কবির নাম।

নাজিম হিকমত সম্পর্কে ফরাসি দার্শনিক জ্যঁ পল সার্ত্র বলেছেন, ‘‘তিনি এমনি একজন কবি যার কাব্য আর জীবনের মাঝে কোনো ভেদরেখা টানা যায় না’’।



আর তাই হিকমতের কাব্যের পাশাপাশি তার জীবনীও অত্যন্ত আগ্রহী করে তোলে পাঠককে। তার সংক্ষিপ্ত জীবনী আলোচনার পাশাপাশি আমরা তার শিল্পকর্ম বা কবিতারও কিছু কিছু আলোচনা করব।


নাজিম হিকমতকে বিশ শতকের আধুনিক কবি হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। যাঁর কবিতা পৃথিবীর প্রায় পঞ্চাশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। জন্ম ১৯০২ সালে তুরস্কের সোলানিকায়, যেখানে তাঁর বাবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। হিকমত বেড়ে উঠেছেন ইস্তাম্বুলে। তাঁর মা একজন শিল্পী ছিলেন, দাদা ছিলেন কবি। মাত্র সতের বছর বয়স থেকেই হিকমতের কবিতার স্ফুরণ ঘটতে থাকে এবং প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর কবিতা। তুরস্কের ন্যাভাল একাডেমিতে কিছুদিন কাজ করার পর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে পশ্চিম তুরস্কে মিলিটারি একাডেমিতে পড়াবার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯২২ সালে প্রথম বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মস্কো চলে যান। রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব তাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করে। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎকালীন শিল্পাঙ্গনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কবি-সাহিত্যিকদের সংস্পর্শে আসেন। ১৯২৪ সালে আবার তুরস্কে ফিরে যান, যে সময়ে তুরস্কের স্বাধীনতা আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু বামপন্থী পত্রিকা প্রচারের অভিযোগে কিছুদিনের মধ্যেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯২৬ সালে আবার তিনি পালিয়ে মস্কো চলে যান, যেখানে রাশিয়ার আরেক বিখ্যাত কবি মায়াকভস্কির সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটে। সেই সময়ের নাট্য-মঞ্চের আরেক দিকপাল মায়ারহোল্ডের সঙ্গে তিনি কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯২৮ সালে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে তাঁকে আবার তুরস্কে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলে হিকমত দেশে ফিরে যান। যেহেতু কমিউনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধ ঘোষিত, তাই হিকমত অনেকটা তুরুপের তাসের মতো কর্তৃপক্ষের দ্বারা ব্যবহৃত হন। অকারণ সন্দেহ আর পর্যবেক্ষণের মাঝে তাঁকে রাখা হতো। ১৯৩৩ সালে পোস্টার লাগানোর অপরাধে তাঁকে জেলে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু বিচারের পর প্রমাণ পাওয়া যায়, হিকমত সেই অপরাধে আদৌ অপরাধী ছিলেন না। ১৯২৯ থেকে ১৯৩৩ সালের মধ্যে তার নয়টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়ে যায়। যার মধ্যে চারটি দীর্ঘ বিপ্লবী কবিতা ছিল। কবিতা ছাড়াও বেশকিছু নাটক, উপন্যাস, চিত্রনাট্য, শিশুদের জন্য গল্প লেখেন, প্রুফরিডার, অনুবাদক আর সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন। দুই সন্তান, দ্বিতীয় স্ত্রী আর বিধবা মা নিয়ে তখন তাঁর সংসার।

১৯৩৮ সালে তাঁর জীবনে নেমে আসে কালো মেঘের ছায়া, গ্রেফতার হন, সাজাপ্রাপ্ত হন আটাশ বছরের কারাজীবনে। কী তার অভিযোগ? তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ- তাঁর কবিতা তুর্কি সেনাবাহিনীকে উত্তেজিত আর বিদ্রোহী করে তুলছে। বিশেষত, ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত, ১৫০০ শতাব্দীর অটোমান সাম্রাজ্যের সময়ে সংঘটিত কৃষক বিদ্রোহের ওপর ভিত্তি করে রচিত ‘‘The Epic of Sheik Bedrettin’’ শীর্ষক দীর্ঘ কবিতাটির কথা উল্লেখিত হয়। হিকমতের খুব কাছের বন্ধু আরেক দিকপাল কবি, কবি পাবলো নেরুদার বর্ণনায় পাওয়া যায় তার নিদারুণ কারাভোগের কাহিনীর কথা- ‘‘যতক্ষণ পর্যন্ত না হিকমত ক্লান্ত হয়ে পড়তেন ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁকে দীর্ঘ সময় ধরে হেঁটে যেতে বলা হতো। তারপর তাঁকে বিষ্ঠাপূর্ণ টয়লেটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রাখা হতো’’।

কিন্তু হিকমত এতে দমেননি। এই জেলেই তিনি অনেক গান আর কবিতা রচনা করেন, যেগুলো তার বন্ধুদের দিয়ে বাইরে সরবরাহ করা হতো। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে তিনি অনেক গান আর কবিতা রচনা করেন, ‘‘Human Landscape’’ যার মধ্যে অন্যতম একটি মহাকাব্য। এই জেলে থাকা অবস্থাতেই দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে এবং তৃতীয়বারের মতো আবার বিয়ে করেন। ১৯৪৯ সালে একটি আন্তর্জাতিক কমিটি ছিল, যার সদস্য ছিলেন- পাবলো পিকাসো, পল রবিনসন এবং জ্যঁ পল সার্ত্র-এর মতো দিকপালরা, তাঁরা হিকমতের মুক্তির জন্য প্যারিসে প্রচারণা শুরু করেন এবং অবশেষে হিকমত কারামুক্ত হন। তবে এই সময়েই তার প্রথম হার্ট অ্যাটাক হয়।

১৯৫০ সালে তাঁকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। তাঁর ‘‘অটোবায়োগ্রেফি’’ নামক কবিতায় দেখি-
‘‘কিছু মানুষ জানে সব গাছ-পালা আর মাছের নাম
আমি জানি বিচ্ছেদ
কিছু মানুষ হৃদয়ে রাখে তারাদের নাম
আমি আবৃত্তি করে যাই নীরবতা
আমি শুয়েছি জেলখানায়, শুয়েছি শ্রেষ্ঠ হোটেলে
আমি চিনেছি ক্ষুধাকে, চিনেছি অনশন-ধর্মঘটকে, যেখানে খাবার প্রায় থাকে না
তিরিশে আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাতে চাইলো
পঞ্চাশে দিলো নোবেল ….’’

জেল থেকে মুক্তির পরেও তাঁকে দু’দুবার হত্যা করার প্রচেষ্টা চলে। দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় তাঁর জীবন সংকটাপন্ন হয়ে পড়লে তাঁকে মস্কোয় নিয়ে যাওয়া হয়। মস্কোয় রাইটার কলোনিতে তাঁকে একটি বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু তার স্ত্রী আর সন্তানদের মস্কোয় যাওয়ার অনুমতি দেয় না তুরস্ক সরকার। ১৯৫২ সালে তার আবার দ্বিতীয়বার হার্টঅ্যাটেক হয়। সুস্থ হওয়ার পর তিনি ইউরোপের নানান দেশসহ এশিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেন। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের কোনো অনুমতি না দেওয়ায় সেখানে তাঁর যাওয়া হয়ে ওঠে না। ১৯৫৯ সালে তিনি পোল্যান্ডের সিটিজেনশিপের জন্য আবেদন করেন এবং সেই বছরেই আবার বিয়ে করেন।

ইতিমধ্যে জার্মান, ফরাসি এবং অন্যান্য ভাষায় তাঁর কবিতা অনূদিত হতে শুরু করে। ১৯৬৩ সালে তৃতীয়বারের হার্ট অ্যাটাকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর এক বছরের মধ্যেই অর্থাৎ ১৯৬৫-৬৬ সালের মধ্যেই তুরস্কে তার কবিতার ভলিয়্যুমসহ পুনর্মুদ্রণ শুরু হয়ে যায়। এবং পরবর্তী পনের বছর ক্রমে ক্রমে তার আটটি ভলিয়্যুমে তাঁর সব লেখা তুরস্কে প্রকাশিত হয়। সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয় তাঁর রচনা।

কবি হুইটম্যানের মতো নাজিম হিকমত তাঁর কবিতায় যেভাবে বলেছেন তাঁর নিজের কথা, দেশের কথা সেই একইভাবে বলে গেছেন বিশ্বের কথা। আত্মকেন্দ্রিকতার ঊর্ধ্বে গিয়ে তিনি একাধারে ছিলেন ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত। তাঁর কবিতা একাধারে বাস্তব এবং আবেগ প্রবণতায়পূর্ণ। মানবিকতার স্পর্শে তাঁর কবিতাগুলো যেন- নাটকীয়, আশাবাদী এবং শিশুসুলভ আনন্দেপূর্ণ- যা তাঁকে করেছে উন্মুক্ত, গণমুখী এবং অন্যধারে সামাজিক ও শিল্পীত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নিবেদিত। তাঁর জীবন এবং কর্মের এই এককত্ব তাঁকে তাঁর সময়ের নায়ক করে তুলেছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, তাঁর কবিতা এবং জীবন আলাদা কোনো ঘটনা ছিল না। মার্কিন লেখক টেরেন্স দে প্রেস, যিনি ‘হলোকাস্ট রাইটার’ হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন তিনি বলেন, ‘‘হিকমতের দৃষ্টান্তমূলক জীবন এবং দূরদৃষ্টিতা তাঁকে করে তুলেছে ঐতিহাসিক এবং সময়হীন, মার্ক্সিস্ট এবং মিস্টিক। কারণ শিল্পী হিকমত এবং ব্যক্তি হিকমত প্রকৃতি ও মানব উদ্দীপনার ঐকতান বিরোধীদের শত্রু মনে করতেন। সহজ-সরল ভাষায় গুরুগম্ভীর উপস্থাপন হিকমতের মতো কোনো আধুনিক মার্কিন কবির মাঝে দেখা যায়নি।’’ তাঁর অন্যতম একটি কবিতা- ‘বেঁচে থাকা’য় তিনি লেখেন-
‘‘বেঁচে থাকা কোন কৌতুক নয়
বেঁচে থাকবে ঐকান্তিকতায়, যেমন থাকে কাঠবিড়ালীরা
অর্থাৎ সবকিছুর ঊর্ধ্বে যেয়ে বেঁচে থাকো
অর্থাৎ বেঁচে থাকা হচ্ছে বৃত্তিমূলক জীবন’’ ….।

তাঁর অভিশংসনকারীরাও তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখেছে, যখন তারা দেখল কারোর কবিতা সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও উদ্বেলিত করতে পারে। জীবনভর শতকষ্টের মাঝেও কখনোই তাঁর জীবন বা শিল্পের সঙ্গে তিনি কোনো আপস করেননি। আর তাই ‘‘The sad state of Freedom’’ বা ‘‘বিষন্নতার স্বাধীনতা’’ কবিতায় স্বাধীনতার অসাধারণ বিষন্নতাকে আমরা খুঁজে পাই। তাঁরএই কবিতা দিয়েই তাঁর জন্মদিনে তাঁকে আমরা শ্রদ্ধা জানাব।

‘‘তুমি তোমার চোখ দুটোকে নষ্ট করেছো
নষ্ট করেছো তোমার লাবণ্যময় হাত দুটো
হাজার রুটির জন্যে ময়দার ময়ান করেছো
যার একটুকরো তোমার মুখে জোটেনি
তুমি স্বাধীন অন্যের দাসত্ব করার জন্যে
তুমি স্বাধীন অন্যকে ধনী থেকে ধনীতর করার জন্যে
যে মুহূর্তে তুমি জন্ম নিয়েছো
তারা তোমার চারপাশে রোপণ করেছে
জীবনভর মিথ্যার জাল
যে মিথ্যা উৎপাদিত হয় মিলগুলোতে
তুমি জীবনভর স্বাধীনতার বাসনা করে চলেছো
মন্দিরে প্রার্থনা করেছো
স্বাধীনভাবে ভাবতে চেয়েছো
তুমি ঘাড় নুয়ে থেকেছো
হাতদুটো ঝুলিয়ে
অলসভঙ্গিতে ঘুরেছো মুক্তির আশায়
তুমি মুক্ত
মুক্ত তুমি বেকারত্বের জালে
তুমি তোমার দেশকে ভালোবেসেছো
পৃথিবীর সব থেকে মূল্যবান রত্নটির মতো
কিন্তু হঠাৎ একদিন (উদাহরণস্বরূপ)
দেশটিকে তারা আমেরিকার কাছে স্বত্বপ্রদান করে দিলো
এবং সেই সঙ্গে তুমি এবং তোমার স্বাধীনতাকেও
স্বাধীনতা পেলে বিমান-ঘাঁটি হবার
তুমি প্রচার করলে মানুষ বেঁচে থাকবে
যন্ত্রবত নয়, নয় কোনো সংখ্যা বা সংযুক্তি হিসেবে
থাকবে বেঁচে মানুষ হিসেবে
ঠিক তখন তোমাকে হাতকড়া পরিয়ে দেবে ওরা
তুমি বন্দিত্বের জন্যে মুক্ত হয়ে গেলে
মুক্ত হলে কারাগারে বা এমনকি মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হয়ে
মানুষের জীবনে নেই কোনো লোহা বা কাষ্ঠবত
এমনকি সূক্ষ্ম কারুকাজপূর্ণ পর্দা
জীবনে স্বাধীনতা চাইবার কোনো প্রয়োজন নেই
তুমি মুক্ত
আকাশের তারার নিচে বিষন্ন স্বাধীনতার মতো মুক্ত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন